বল্লাল ঢিপির গল্প: এক মহাকালের ছায়া




 বল্লাল ঢিপির গল্প: এক মহাকালের ছায়া

আমি ময়ূখ, ইতিহাসের একজন নীরব অনুরাগী। মায়াপুরে প্রথমবার যাওয়ার কথা ওঠার পর থেকেই হৃদয়ে এক অজানা কৌতূহলের ঢেউ জেগে উঠেছিল। লক্ষ ছিল বল্লাল ঢিপি—বল্লাল সেনের তৈরি সেই রহস্যময় ধ্বংসাবশেষ। এক পাণ্ডিত্যপূর্ণ রাজার প্রাসাদ কিংবা এক কিংবদন্তীর নীরব সাক্ষ্যস্থান, সেটি ঠিক কী, তা আমিও জানতাম না।

পথে যেতে যেতে ভাবছিলাম, কত শতাব্দী ধরে এই ধ্বংসাবশেষ একা দাঁড়িয়ে আছে, সময়ের সাক্ষী হয়ে। ইতিহাসের সুনামির আঘাতে কত ঘটনার ইঙ্গিত রয়েই গেছে এর গায়ে, আর কতটাই-বা হারিয়ে গেছে চিরতরে। বল্লাল ঢিপিতে পৌঁছে তুষারাবৃত মন্দিরের মতো এক নীরবতায় নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম।

ঢিপি বলতে হয়ত অনেকেই শুধু ইটের স্তূপ কল্পনা করে। কিন্তু বল্লাল ঢিপির গঠন যেন খসে পড়া রাজ্যের গোপনপত্র! একটি সময়জয়ী শিল্প, যা জীবনের কাছে আজও অমর গল্প শোনায়। সূর্যের আলো ঢিপির মাটি আর ইটকে রক্তচন্দনের রঙে রাঙিয়ে তুলছিল। আমি চুপচাপ চারপাশ দেখছিলাম। গাইডবই বলছিল, এখানে কোনও একসময় ছিল এক সুবিশাল প্রাসাদ, রাজা বল্লাল সেনের গড়া।

কিন্তু স্থানীয়দের মুখে শোনা এর গল্প ছিল ভিন্ন। এক বৃদ্ধা বলছিলেন, “এই ঢিপির নিচে না জানি কত অভিশপ্ত আত্মা লুকিয়ে আছে। রাজা বল্লালের সময় এই জমি ছিল উর্বর। রাজা এখান থেকে সরাসরি গঙ্গাকে দেখতে পেতেন। কিন্তু এক অভিশপ্ত দিনে এক যোগিনী এই রাজ্যকে ধ্বংস করার শাপ দেয়। সেই থেকে রাজপ্রাসাদ ভেঙে ধুলোয় মেশে। আজও রাতে এখানে কেউ যায় না। আলো জ্বলে আর অনাথ কান্নার আওয়াজ শোনা যায়!”

আমি বৃদ্ধার গল্পে স্পষ্ট হেসে ফেললেও, ভিতরে কোথাও সেই রহস্যের আঁচ টের পাই। স্থানীয় গ্রামবাসীরা ঢিপির ভেতর খুঁজে পেয়েছে অসংখ্য প্রাচীন মুদ্রা আর পাথরের মূর্তি। বল্লাল সেনের আমলের খোদাই করা প্রতিটা অক্ষর যেন এক যুগান্তকারী শাসকের কথা বলে।

এক কোণে দাঁড়িয়ে তখন দূরের গঙ্গাস্রোতের আওয়াজ শুনছিলাম। অযুত-শতাব্দীর প্রতিধ্বনি যেন ঢিপির প্রতিটি ইটে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল।

আমার মাথায় তখন কেবল একটাই ভাবনা। হয়ত সময় ধ্বংস করে দিতে পারে ভবন, রচনা বদলে দিতে পারে কাহিনি। কিন্তু বল্লাল ঢিপি হারায়নি তার গল্প বলার ক্ষমতা। কি ইতিহাসপ্রেমী, কি ভ্রমণপিপাসু, এই স্থান সবাইকে কৌতূহল আর বিস্ময়ে বেঁধে রাখে।

ফিরতে দেরি হচ্ছিল। কিন্তু ঢিপির নিচের ইতিহাসের পাথরখোদাই থেকে যেন চোখ সরাতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল, একদিন হয়তো কোনও পুরাণ-পুরোহিত এসে এই কাহিনীর সব রহস্য ফাঁস করবে। কিংবা হয়ত, বল্লাল ঢিপি তার গল্পের চাবিকাঠি চিরতরে নিজেই লুকিয়ে রেখেছে।

আমার ইতিহাসের মায়া আজও আমাকে বল্লাল ঢিপির ছায়ায় ফিরিয়ে নেয়। মায়াপুর শুধু মন্দিরের নগরী নয়, এর প্রতিটি ইট-কণা অতীতের এক বিস্ময়। গল্পের ভাঁজগুলিকে ধরে রাখে বল্লাল ঢিপি। আর আমিও, এর এক থমকে থাকা শ্রোতা।

ভিডিও লিঙ্কঃ https://youtu.be/HpWIK8e1kR8

Comments

Popular posts from this blog

চাঁচল রাজবাড়ি: ৩০০ বছরের ইতিহাসের সাক্ষী 🏰✨

📍 ৫০০ বছরের পুরনো ইতিহাসের সাক্ষী – চাঁদ কাজীর সমাধি! 🏛️✨